গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে নদীনালা, খালবিল, পুকুর ও জলাশয় এখন পানিতে ভরে গেছে। তাই এখন মাছ চাষের উপযুক্ত সময়। তাই বরিশালের আগৈলঝাড়ায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা বেচাকেনার ধুম পড়েছে। এতে এ অঞ্চলের পোনা উৎপাদনকারী ও ক্রেতা-বিক্রেতা সকলেই খুশি।
জানা গেছে, বৃষ্টি ও অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এ বছর মাছের পোনার উৎপাদন ও বেচাকেনা উভয়ই বেড়েছে। সারা বছর এই বাজারে পোনামাছ বিক্রি করা হয়। তবে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পোনামাছ বিক্রির মৌসুম হওয়ায় এই ছয় মাস বাজার বেশি জমজমাট থাকে। উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের দাশেরহাট মাছ বাজারে প্রতিদিন ভোর ৭টার দিকে শুরু হয় বেচাকেনা, চলে সকাল ৯টা পর্যন্ত। দুই ঘণ্টার বাজারে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার পোনা মাছ বিক্রি করা হয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভোরের আলো ফোটার কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে সরগরম হয়ে উঠেছে আগৈলঝাড়া-গোপালগঞ্জ মহাসড়কের পাশে দাশেরহাট মাছবাজার। বিক্রেতারা ট্রাক, পিকআপ, ইঞ্জিনচালিত নছিমনসহ বিভিন্ন গাড়িতে অ্যালুমিনিয়ামের বড় বড় পাতিল, বড় বড় প্লাস্টিকের ড্রামে পানি দিয়ে মাছের পোনা নিয়ে জড়ো হচ্ছেন। ওই সব গাড়িতে করেই নিজ গন্তব্যে পোনা নিয়ে যাচ্ছেন দূরদূরান্ত থেকে আসা ক্রেতারা। মাছবিক্রেতা ও ক্রেতারা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে এ বাজারে পোনা বেচাকেনা করছেন।
কোটালীপাড়া উপজেলার ক্রেতা জাহিদুল খান বলেন, ‘বর্ষায় পুকুর পানিতে ভরে গেছে। এখন পোনা ছাড়ার উপযুক্ত সময়। এ বাজারে ভালো জাতের বিভিন্ন সাইজের ছোট মাছের পোনা পাওয়া যায়। তাই প্রতিবছর এখান থেকে পছন্দের পোনা সংগ্রহ করি।’
ছোট পোনা মাছ ক্রেতা শহীদ হোসেন জানান, এ অঞ্চলের মাছের পোনার চাহিদা মেটানোর পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিদিন এ বাজারে প্রায় শতাধিক ফার্মের মালিকেরা মাছের পোনা বিক্রির জন্য আসেন।
উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের গৈলা গ্রামের মাছচাষি হাবুল সরদার বলেন, ‘আমি দুই বছর আগে ৫টি পুকুরে পোনা মাছ চাষ শুরু করি। সব মিলিয়ে চাষে খরচ হয়েছে ১ লাখ টাকা। বর্তমান বাজার দরে ওই সব পুকুরের উৎপাদিত পোনা ৪ লাখ টাকা বিক্রি হবে। আশা করছি, এ বছর ৩ লাখ টাকার অধিক লাভের।’
উপজেলার মৎস্য ফার্মের মালিক শামীম ফড়িয়া, জুলহাস বেপারীসহ একাধিক ব্যবসায়ী জানান, প্রতিবছর বর্ষা এলেই পোনার চাহিদা বেড়ে যায়। এ বাজারে কয়েক বছর ধরে পোনা মাছ বিক্রি হয়ে আসছেন তাঁরা। এ বাজারে পোনা মাছ বিক্রির সুনাম দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিড়।
ছোট পোনা মাছ ব্যবসায়ী হালিম সরদার বলেন, যশোরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে উন্নত জাতের মাছের ডিম সংগ্রহ করে উপজেলার মৎস্য ব্যবসায়ীরা রেণু ফোটায়। ওই সব রেণু ২ থেকে ৫ ইঞ্চি হলে ব্যবসায়ীরা বাজারে বিক্রি করে অধিক লাভবান হচ্ছেন। ওই সবের মধ্যে রয়েছে রুই, কাতলা, মৃগেল, তেলাপিয়া, নাইলোনটিকা, কারফু, পাঙাশ , চায়নাপুঠিসহ প্রায় ১৫ থেকে ২০ প্রজাতির বিভিন্ন জাতের মাছ।
মাছ ব্যবসায়ী মজিবর হোসেন জানান, অনেক বছর ধরে তিনি এ বাজারে মাছের পোনা বিক্রি করে আসছেন। মাছের খাবারের দামবৃদ্ধি হওয়ায় আগের বছরের চাইতে এ বছর মাছের পোনা বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। মাছের খাবারের মূল্য কম হলে মাছের পোনার দাম কম হতো বলেও জানান তিনি।
দাশেরহাট মৎস্য বাজারের সাধারণ সম্পাদক বাবুল বেপারী বলেন, ‘প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাছের পোনা কিনতে ক্রেতারা এ বাজারে আসেন। এখানে রুই, কাতল, সরপুঁটি, গ্রাসকার্প, মৃগেল, পাঙাশ, বিগহেড, সিলভারকার্প ও অন্যান্য কার্প জাতীয় ছোট পোনা মাছ আকারভেদে কেজি দরে ও পিস হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে।’
দাসেরহাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সহসভাপতি শরীফ ইলিয়াস জানান, এ এলাকার কয়েকশ মৎস্যচাষি বিভিন্ন নালা, ডোবা ও পুকুরে পোনা মাছের আবাদ করে শতাধিক লোকজন স্বাবলম্বী হয়েছেন। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে ব্যবসায়ীরা দাসেরহাটে এসে কাছ কিনে নায়ে যান। পরে ট্রাক, মিনিট্রাক, নসিমন ও ভ্যান করে সেসব মাছের পোনা বিভিন্ন এলাকার হাটবাজার ও গ্রামাঞ্চলে বিক্রি করছেন। দাসেরহাট বাজার থেকে স্বল্পমূল্যে পোনা মাছ কিনে অন্য বাজারে আবার অধিক মূল্যে বিক্রি করে তাঁরা লাভবান হচ্ছেন। স্বল্প পুঁজিতে অধিক লাভবান হওয়ায় মানুষজন অন্য পেশা ছেড়ে এ পেশায় ঝুঁকে পড়েছেন বলেও জানান তিনি।
দাসেরহাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির কার্যকরী সদস্য সবুজ বেপারী জানান, এ বাজারটি গৌরনদী-আগৈলঝাড়া মহাসড়কের পাশে অবস্থিত হওয়ায় এখন পোনা মাছ বিক্রির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এ বাজারে প্রতিনিয়ত ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, ভাঙা, গোপালগঞ্জসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন ট্রাক, মিনিট্রাক, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহন নিয়ে ক্রেতারা পোনা মাছ কেনার জন্য আসেন।
এ বিষয়ে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘মাছের পোনা উৎপাদন, পরিবহন ও বিপণনে এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা মাছচাষিদের পোনা উৎপাদন, সংগ্রহ ও চাষ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা করে আসছি।’