ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে সড়ক পথে বরগুনার পাথরঘাটার দূরত্ব ৩৩৪ দশমিক ৬ কিলোমিটার। এই দূরত্বে একটি বাস আসতে বর্তমানে (পদ্মা সেতু হওয়ার পর) সময় লাগে প্রায় ৬ ঘণ্টা। একই পথে আগে ফেরি পার হয়ে আসতে লাগতো দ্বিগুণেরও বেশি সময়। এ রুটে বাস চলে অর্ধশতাধিক। কিন্তু পরিবহন চালকরা এতো দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ঢাকা থেকে পাথরঘাটায় এলেও তাঁদের পূর্ণাঙ্গ বিশ্রামের আগেই আবার যাত্রী নিয়ে ছুটতে হয় ঢাকার দিকে।
গ্রামীণ পরিবহনের একজন চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ঢাকা থেকে সন্ধ্যা সাতটায় রওনা হয়ে পাথরঘাটায় পৌঁছাতে রাত ১২টা থেকে ১টা বাজে। এরপর যাত্রী নামিয়ে বাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে লাগে আরও প্রায় একঘণ্টা। গন্তব্যে এসে রাতে খেয়ে-না বাসের মধ্যেই ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়ে আবার ভোর সাড়ে ৫টায় বাসে যাত্রী নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হতে হয়। কিন্তু ছাড়ার আধাঘণ্টা আগেই যাত্রীরা বাসে উঠে পড়ায় ঘুম হয় ঘণ্টা দুই। এতে শরীর খারাপ হয়, মেজাজও বিগড়ে যায়। ফলে বাস চালাতে গিয় মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন। আর এ কারণেই ঘটে দুর্ঘটনা। এসব বিষয়ে মালিক পক্ষকে বলা হলেও তাঁরা বুঝতে চান না। তারা বলে- যেকোন ভাবেই ট্রিপ ঠিকভাবে ধরতে হবে।
ঢাকা-বরিশাল রুটের সবুজ আহমেদ নামের এক যাত্রী বলেন, অধিকাংশ বাস নির্ধারিত সময়ের পরে স্টেশন থেকে ছাড়ে। মাঝপথে বিভিন্ন কাউন্টার থেকে যাত্রী তোলে। এরপর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য ইচ্ছেমতো বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালায়। এসব কারণে সড়ক-মহাসড়কে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো প্রতিকার নেই।
ব্যক্তিগত গাড়ির ক্ষেত্রেও দুর্ঘটনার কারণ প্রায় একই রকম। গাড়ির মালিক বিভিন্ন গন্তব্যে গিয়ে ঠিক সময়ে খাওয়া ও বিশ্রাম নিলেও চালকের কথা ভাবেন না। অনেক সময় মালিক হোটেলে কিংবা কোনো বাসায় থাকেন। আর চালককে সময় কাটাতে হয় গাড়ির মধ্যেই। এতে চালকদের মধ্যে একঘেয়েমি ভাব, মেজাজ বিগড়ে যাওয়াসহ মস্তিস্কে নানারকম সমস্যা সৃষ্টি হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।
গত রোববার (১৯ মার্চ) মাদারীপুরে সকাল সোয়া ৮টার দিকে ইমাদ পরিবহনের যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে ২০ জন প্রাণ হারান। আহত হন অর্ধশতাধিক যাত্রী। ইমাদ পরিবহন নামে বাসটি খুলনা থেকে ঢাকার দিকে যাচ্ছিল। এর আগে গত ১৭ মার্চ (শনিবার) পিরোজপুরসহ তিন জেলায় ১০ জন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। আহত হন ১৪ জন।
এছাড়া ২০২২ সালের ২৯ মে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার সানুহার এলাকায় বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ১১ যাত্রীর মৃত্যু হয়। ওই বছরের জুলাই মাসে বাকেরগঞ্জ এলাকায় বিআরটিসি বাসের ধাক্কায় ইজিবাইকের চালকসহ ছয়যাত্রী ও উজিরপুরের শিকারপুরে বাসের ধাক্কায় পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের ছয় যাত্রী নিহত হন।
মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল:
এদিকে দিন দিন সড়ক দুর্ঘটনা বাড়তে থাকায় আতঙ্কে পড়েছেন যাত্রীরা। তাঁরা বলছেন, পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা না থাকায় একের পর এক দুর্ঘটনায় বহু মানুষ হতাহত হচ্ছেন। কিছুদিন পরপর এসব ঘটনা ঘটলেও সবাই ভুলে যায় বলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না।
বরিশালের পরিবহন খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বরিশাল নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন ঢাকা-বরিশাল, বেনাপোল ও খুলনাসহ বিভিন্ন রুটে আড়াইশোরও বেশি বাস ছেড়ে যায়। এছাড়া অভ্যন্তরীণ ৬টি রুটে চলে আরো ১৮০টি। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৬ জেলার মালিক সমিতির সমন্বয়ে গঠিত রূপাতলী বাস টার্মিনাল থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি রুটে চলাচল করে ৫ শতাধিক মিনিবাস। এই দুটি টার্মিনাল থেকে গড়ে প্রতিদিন যাত্রী চলাচল করে দুই লাখেরও বেশি। অথচ এসব বাস চলাচলের ক্ষেত্রে প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ ও রূপরেখা না থাকায় সবখানেই দুর্ঘটনা ঘটছে। বাস চলছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ইচ্ছে মতো।
পরিবহন চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পদ্মা সেতু চালুর পর বরিশাল থেকে ঢাকার দূরত্ব ১৬০ কিলোমিটার। একজন বাসচালক দূরপাল্লা ও স্বল্প দূরত্বসহ গড়ে রোজ আড়াইশো কিলোমিটার গাড়ি চালান। এতে ঢাকা থেকে বরিশাল আসা যাওয়ায় গাড়ি প্রতি গড়ে আটশো থেকে এক হাজার টাকা মজুরি পান। (গাড়ি ভেদে মজুরি কম-বেশি হয়)। আবার বরিশাল থেকে খুলনায় প্রতি ট্রিপে চালক পান ছয়শো থেকে আটশো টাকা, বরিশাল থেকে বেনাপোল পর্যন্ত ৭০০ থেকে আটশো টাকা দেয়া হয়। হাবিব নামের একজন চালক বলেন, রাস্তায় দুর্ঘটনা ও যানজটসহ নানা ঝামেলা থাকে। তাই সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারায় দিনের অধিকাংশ সময়ই তাদের গাড়ির ওপরই থাকতে হয়। ঈদ-কোরবানির সময় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়। এসময় একদিকে যাত্রীদের চাপ, অন্যদিকে মালিক পক্ষের চাপ এছাড়া চালকদেরও বেশি টাকা আয়ের চেষ্টা থাকে। একই সাথে গাড়ির ফিটনেস দুর্বলতা, বেপরোয়া গাড়ি চালানো ও সরু রাস্তাসহ নানা কারণেও প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে।
দুর্ঘটনার হিসাবে গড়মিল:
সরকারিভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের হিসার রাখা হলেও তথ্যে ব্যাপক গড়মিল পাওয়া গেছে। তাদের হিসাবে দুর্ঘটনা ও নিহতের সংখ্যা অনেক কম দেখানো হয়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয় সূত্র বলছে, ২০২২ সালে বিভাগের ৬ জেলায় ৬৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে আহত হয়েছেন ২০৫ জন, আর নিহত হয়েছেন ৮৮ জন। এদিকে ‘নিরাপদ সড়ক চাই-নিসচা’র প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে বরিশাল বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৮২টি। এতে ৩৯৮ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৮৮৫ জন। এছাড়া ২০২১ সালে বরিশাল বিভাগে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিল ৩৩৫টি। এতে নিহত হন ২৯৪ জন এবং আহত হন ৭৬৯ জন। দুর্ঘটনা ও নিহতের এই সংখ্যা নিসচার প্রতিবেদনের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ।
দুর্ঘটনার কারণ:
প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার ১১১টি কারণ তুলে ধরেছে নিসচা। এতে বলা হয়েছে- চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানোর চেষ্টা, দৈনিক চুক্তিভিত্তিক গাড়ি চালনা, পথচারীদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, নিয়ম না মেনে গাড়ি অতিক্রম (ওভারটেকিং) করা, বিরতিহীন দীর্ঘ সময় একটানা গাড়ি চালানোসহ নানা কারণ।
এ বিষয়ে গাড়ির চালকদেরকেই দায়ী করেছেন বিআরটিএ’র বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক জিয়াউর রহমান। তাঁর দাবি, সড়ক দুঘর্টনা রোধে বিআরটিএ থেকে চালকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও বাস্তবে তারা নিয়ম মানছেন না। এছাড়া, আইন অনুযায়ী একজন চালকের ২৪ ঘন্টার মধ্যে দৈনিক ৮ ঘন্টা গাড়ি চালানোর কথা। এর মধ্যে একটানা ৫ ঘন্টা গাড়ি চালানোর পর আধাঘন্টা বিশ্রাম নিতে হবে। এ বিষয়ে বাস মালিকদেরও সচেতন করা হয়। কিন্তু বাস মালিকদের চেয়ে একজন চালকের দায়ভার বেশি থাকে, কারণ তিনি বাসটি চালাচ্ছেন।