৫ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ বিকাল ৫:৫৫
শিরোনামঃ

বিদেশি প্রতারকদের ব্যাংক হিসাব নিয়ন্ত্রণকারী বিপ্লব লস্কর অধরাই

রিপোর্টার নাম
  • আপডেট টাইমঃ শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ২, ২০২২,
  • 315 সংবাদটি পঠিক হয়েছে

বিদেশি প্রতারকদের ফাঁদে পা দিয়ে লাখ লাখ টাকা খোয়াচ্ছেন দেশের অনেক মধ্যবিত্ত থেকে ধনাঢ্য ব্যক্তি। নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন ও কম্বোডিয়াসহ বেশকিছু দেশের প্রতারকরা হাতিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশিদের টাকা। এসব প্রতারক কখনো বাংলাদেশে বসে আবার কখনো দেশের বাইরে থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে পার্সেলে ডলার অথবা মূল্যবান উপহার পাঠানোর ফাঁদ পেতে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশি এসব প্রতারককে সহায়তা করছে কিছু বাংলাদেশি। প্রতারকদের সহযোগিতা করা সেই বাংলাদেশি চক্রের অন্যতম হোতা বিপ্লব লস্কর (৩৪) নামের এক ব্যক্তি।

পার্সেল প্রতারণা ছাড়াও ডলার ও রেমিটেন্স প্রতারণার ক্ষেত্রে বিদেশিদের সহায়তাকারীও তিনি। কয়েক ধাপে প্রতারণা করে পাওয়া টাকা সর্বশেষ জমা হয় বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে। এসব হিসাব খোলা হয় বিভিন্ন ব্যক্তির নামে। ব্যাংক হিসাবগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন বিপ্লব লস্কর। বিনিময়ে টাকা নেন। ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা তুলে চক্রের বিদেশি সদস্যদের পৌঁছে দেন তিনি।

এভাবে টাকা কামিয়ে কুলি থেকে হয়েছেন ‘কোটিপতি বিপ্লব’। রাজধানীতে তার রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট। বিদেশিদের প্রতারণার শতাধিক ঘটনার সঙ্গে বিপ্লব লস্করের সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।

তবে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও এখন পর্যন্ত তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি এখন কোথায় আছেন সে সম্পর্কেও কোনো খোঁজ জানে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিপ্লব লস্করের বাড়ি গোপালগঞ্জের মকসুদপুরের সালিনা কসা বাজার। বাবার নাম হাসেম লস্কর। তার বিরুদ্ধে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মানি লন্ডারিং আইনে ২০২০ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায়, ২০২১ সালে খিলক্ষেত থানায় ও একই বছর কাফরুল থানায় তিনটি মামলা করেছে।

এছাড়া গত বছর বানানী থানায় ও চলতি বছর পল্টন থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও দুটি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২০১৬ সালে প্রতারণার এক মামলায় গ্রেফতারও হয়েছিলেন বিপ্লব। কিন্তু ছাড়া পেয়ে আবারও প্রতারণায় সহায়তার কাজ শুরু করেন।

যেভাবে বিদেশিদের সঙ্গে সখ্য:
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বিপ্লব লস্করের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে তাদের হাতে। তিনি ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে কুলির কাজ করতেন। ২০০০ সালে চলে আসেন ঢাকায়। সে সময় মিরপুরে ফুটপাতে গার্মেন্টের কাপড় বিক্রি শুরু করেন। ২০০৭ সালের দিকে ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাইজেরিয়ান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ওই শিক্ষার্থীদের মাধ্যমেই আসেনপ্রতারণার জগতে।

পুলিশের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথম পর্যায়ে নিজের নামে বিভিন্ন ব্যাংকে একাধিক হিসাব খুলে নাইজেরিয়ান প্রতারকদের টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় সহায়তা করতেন বিপ্লব। পরবর্তীতে চক্রের সদস্য বাড়িয়ে তাদের নামেও একাধিক হিসাব খোলান। তার কাছে কয়েকশ ব্যাংক হিসাবের চেক ও কার্ড নিয়ন্ত্রণ করতে নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলেছে ব্যাংক এক্সপ্রেস সার্ভিস লিমিটেড। তার চক্রের কোনো কোনো ব্যক্তির নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ২০ থেকে ২৫টি হিসাবও আছে। এসব হিসাবধারী যে ঠিকানা দিয়ে হিসাব খোলেন সেখানে থাকেন না। এমনকি তাদের নিকট আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগও রাখেন না। টাকা লেনদেনের একটি বড় অংশ বিপ্লব লস্কর রেখে হিসাবধারীদের দেন লেনদেনের ২ শতাংশ টাকা।

যেভাবে ঘটছে প্রতারণা:
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাস্টমস ডিপার্টমেন্ট, কলিং ডিপার্টমেন্ট ও ব্যাংক এক্সপ্রেস সার্ভিস খুলে কয়েক ধাপে প্রতারণা করছে চক্রটি। একটি অংশের সঙ্গে অন্য অংশের যোগাযোগ হয় হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। মূলত বিদেশি এসব প্রতারক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে। এরপর বন্ধুকে বিদেশ থেকে উপহার হিসেবে কখনো ডলার আবার কখনো মূল্যবান জিনিসপত্র পাঠানোর কথা বলে। এ পর্যন্ত সক্রিয় থাকে বিদেশি প্রতারকরা। এরপর সক্রিয় হয় প্রতারকদের কলিং ডিপার্টমেন্ট, এখানে রয়েছে বাংলাদেশিরা। এরা কাস্টমস কর্মকর্তা সেজে বাংলাদেশের টার্গেট ব্যক্তিকে ফোন করে বলে- ‘আপনার পার্সেল এলেও কাস্টমসের ফি পরিশোধ করা হয়নি। বিভিন্ন পরিমাণের টাকা কাস্টমস ফির কথা বলা হয়।’

এই কলিং ডিপার্টমেন্ট থেকেই নম্বর দেওয়া হয় টাকা পরিশোধের জন্য। টাকা দেওয়ার পর ওই কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি জানায়, স্ক্যানিংয়ে আপনার পার্সেলে অবৈধ মালামাল পাওয়া গেছে। এগুলো ছাড়াতে ১ থেকে ৫ লাখ টাকা দাবি করে। ভুক্তভোগী এ টাকা দেওয়ার পর প্রতারক চক্র আবার ফোন করে জানায় ঘটনা সিনিয়র অফিসাররা জেনে গেছেন। আরও ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা লাগবে। অন্যথায় আপনার (ভুক্তভোগীর) বিরুদ্ধে মামলা হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে টাকা পাঠাতে প্রতিবারই নতুন নতুন হিসাব নম্বর দেওয়া হয়।

ভুক্তভোগীদের মামলা:
বিদেশি প্রতারকদের ফাঁদে পা দিয়ে টাকা খুইয়ে গত বছরের ২১ জানুয়ারি রাজধানীর পল্টন মডেল থানায় মামলা করেন জামিল হোসেন ভূঁঞা নামের এক ব্যক্তি।

এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, ২০২০ সালে ফেসবুকের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে অবস্থানকারী মিথিলা নামের এক নারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ওই নারী জানান, তার স্বামী বাংলাদেশি ছিলেন। কিছুদিন আগে তিনি মারা গেছেন। স্বামীর জমানো টাকা তিনি বাংলাদেশের গরিব মানুষকে দিতে চান। এজন্য বাংলাদেশের কাস্টমসের মাধ্যমে কিছু টাকা জামিল হোসেনকে পাঠাতে চান। এরপর ২০২০ সালের ৪ আগস্ট জামিল হোসেনকে ফোন করে এক ব্যক্তি নিজেকে কাস্টমস অফিসার পরিচয় দিয়ে জানান একটি পার্সেল এসেছে, এর কাস্টম চার্জ বাবদ ৭৭ হাজার টাকা লাগবে। তাদের দেওয়া সাউথইস্ট ব্যাংকের সাকিবুল হাসান নামের একটি হিসাবে টাকা পাঠান জামিল হোসেন। পরে নানা কৌশলে দুই দফায় ১ লাখ ৮৫ হাজার ও ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা নেন। এরপরই ভুক্তভোগী বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

বিদেশিদের প্রতারণার শিকার হয়ে গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বনানী থানায় মামলা করেন আহসান হাবিব নাসিম নামে এক ব্যক্তি। তিনি এ চক্রের খপ্পরে পরে ৭ লাখ টাকা খুইয়েছেন। মো. হাবিবুর রহমান নামের আরেক ব্যক্তি এ চক্রের কাছে ২১ লাখ ২৫ হাজার টাকা খুইয়ে গত বছরের ৫ মার্চ বনানী থানায় মামলা করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, বিপ্লব লস্করের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। পল্টন থানা ও বনানী থানার দুটি প্রতারণার মামলা তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। যেসব ব্যাংক হিসাবে ভুক্তভোগীরা টাকা জমা দিয়েছেন সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করছেন বিপ্লব লস্কর। গত আড়াই বছর ধরে তাকে পুলিশ খুঁজছে। তাকে গ্রেফতার করা গেলে বাংলাদেশি অনেক ভুক্তভোগী প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাবেন এবং চক্রের বিদেশি প্রতারকদেরও খুঁজে পাওয়া যাবে।

এই পোস্টটি শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ ...

© All rights reserved © 2021
Developed By Engineerbd.net
EngineerBD-Jowfhowo