বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। এ যেন সার্কাসের মঞ্চ। আর খেলোয়াড়রা সেই সার্কাসের জাদুকর। কখনো হাসান আবার কখনো কাঁদান। সবার আগে এশিয়া কাপে ‘দর্শক’ বনে যাওয়া বাংলাদেশ কেন হারল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। দায়টা কাদের ছিল?
গতকাল ব্যাটিংয়ের শুরুটা প্রথম ম্যাচের মতো হতশ্রী কায়দায় করেনি বাংলাদেশ। নিজের প্রথম বলেই সাব্বির রহমানের সাহসী স্কুপে শেষমেষ নির্ভীকতার ছাপ দেখতে পেয়েছিলেন ভক্তরা। মেহেদী হাসান মিরাজ ছিলেন দুর্দান্ত, তার অনবদ্য ৩৮ রানে বহুদিন পর পাওয়ারপ্লে কাজে লাগিয়েছে বাংলাদেশ। পরবর্তীতে আফিফ হোসে ধ্রুব ও মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের ক্যামিওতে চলতি এশিয়া কাপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংগ্রহ গড়ে টাইগাররা।
ব্যাটাররা তাদের কাজটা ঠিকমতোই করেছিলেন। এই হারের দায় নিতে হবে বোলারদেরই। তার ওপর বাজে ফিল্ডিং ও রিভিউ দুর্বলতা তো আছেই। চলুন দেখে আসা যাক কোন ভুলগুলো না করলে টাইগারদের বদলে আজ দেশের বিমান ধরতে হতো লঙ্কানদের।
মাহেদি-এবাদতের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ
১৮তম ওভারে যখন শেখ মাহেদির হতে বল তুলে দেন সাকিব তখন নির্ধারিত ওভার রেটের থেকে এক ওভার পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। স্লো ওভার রেটের সাজা কতটা ভয়ানক হতে পারে তা ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ থেকে সহজেই অনুমেয়। পাকিস্তানকে ম্যাচ খোয়াতে হয়েছিল বাবর আজম ও তার বোলারদের ধীরস্থির অ্যাপ্রোচের জন্য।
ফেরা যাক মাহেদি প্রসঙ্গে। ওভারের প্রথম বলটা করতেই নিলেন অনেকটা সময়। পরের বলগুলোতেও তার ব্যত্যয় হয়নি। প্রতিটি বল করে এমনভাবে রুমাল দিয়ে বল মোছায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন এই অলরাউন্ডার যেন হাতে তার অনন্ত সময়। যাই হোক, সেই ওভারে ৮ রান দিলেও তুলে নিয়েছিলেন দাসুন শানাকার মহাগুরুত্বপূর্ণ উইকেট। নতুবা ম্যাচ হয়ত শেষ ওভার পর্যন্ত গড়াতোই না।
এদিকে, এবাদত হোসেন চৌধুরী কাল দেখেছেন মুদ্রার দু’পিঠই। প্রথম দুই ওভারের ‘নায়ক’ শেষ দুই ওভারে বনে গেছেন ‘খলনায়ক’। ১৯তম ওভারে এবাদতকে আক্রমণে ফেরান সাকিব। তখনও লঙ্কানদের জিততে প্রয়োজন ১২ বলে ২৫ রান। প্রথম বলেই পায়ের পেশিতে চোট পান এবাদত। সংগ্রাম করতে দেখা যায় তাকে।
নিজেকে সামলে বোলিং লাইনআপে ফিরে গেলেও সেখানে আবারও স্ট্রেচিং করে সময় নষ্ট করেন ডানহাতি পেসার। অধিনায়ক সাকিব বেশ ক’বার ছুটে এসে কিছু একটা বলেনও এবাদতকে। হয়ত মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই। তবু দলের বিপদের চেয়ে নিজেকে ইনজুরি থেকে বাঁচানোটাই যেন বেশি গুরুত্ব পেল এবাদতের কাছে!
টেলিভিশনে ধারাভাষ্যকারও বার বার বলছিলেন সেকথা। এবাদতের এমন স্বার্থপর আচরণ দেখে গতকাল আরও একবার মনে পড়ে গেল টি-টোয়েন্টিকে বিদায় বলা ওয়ানডে কাপ্তান তামিম ইকবালের কথা। ভয়ানক বিপদে পড়তে পারেন যেনেও শুধু দেশের জন্য ভাঙা হাত নিয়ে নেমে পড়েছিলেন সুরাঙ্গা লাকমলকে সামলাতে।
শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে যখন পুনরায় দৌড় শুরু করলেন এবাদত, ততক্ষণে বাংলাদেশের শাস্তি হয়ে পড়েছে অনিবার্য। যার খেশারত দিতে হলো মাহেদির শেষ ওভারে এসে। ৩০ গজ বৃত্তের বাইরে থাকা ৫ জন ফিল্ডারের একজনকে চলে আসতে হলে ভেতরে। আসিথা ফার্নান্দোও লং অন খালি পেয়ে চার মেরে ম্যাচ নিয়ে এলেন শ্রীলঙ্কার নাগালে।
‘ওয়াইড-নো’র রসের হাড়ি
কাল যেন ‘অতিরিক্ত রানের’ পসরা সাজিয়ে বসেছিল টাইগাররা। মোট ১৭ রান এসেছে অতিরিক্ত খাত থেকে যার মধ্যে ছিল ৬টি ওয়াইড বল ও ৪টি নো বল! এদিকে লেগ বাই ও বাই থেকে আসা রান বাদ দিলে বাংলাদেশ ব্যাটারদের কোন অতিরিক্ত রানই দেয়নি শ্রীলঙ্কা।
এক এবাদতই করেছেন ৬টি ওয়াইড ও ২টি নো বল। একজন টেস্ট বোলারের আর যাই হোক লাইন লেন্থের ওপর নিয়ন্ত্রণ সীমিত ওভারের বোলারদের তুলনায় বেশি থাকার কথা। তবে চাপের মুখে ভেঙে পড়েছেন বিমান বাহিনীর এই সৈনিক, বারবার হয়েছেন লাইনচ্যুত।
মাহেদির কথাও বলতে হয় এখানে। ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে নো বল তো করেছেনই, সপ্তম ওভারে তার করা আরেকটি নো বলে বিশাল খেশারত দিয়েছে বাংলাদেশ। কুশাল মেন্ডিস আউট হয়েও বেঁচে যান নো বলের কল্যাণে। সেই মেন্ডিস পরবর্তীতে ৩৭ বলে ৬০ রান করে দিলেন টাইগার বধের নেতৃত্ব। ম্যাচসেরার পুরস্কারও জিতলেন তিনি।
‘ক্যাচমিস’ ও সাধের ‘রিভিউ’
বাংলাদেশ কোন ম্যাচ খেলবে আর টাইগার ফিল্ডাররা ক্যাচ মিস করবে না এ যেন কল্পনাতেও অসম্ভব। গতকারও বার লঙ্কান ব্যাটারদের ক্যাচ ফেলেছে সাকিব বাহিনী। শুরুটা মুশফিকুর রহিমকে দিয়ে যিনি উইকেটের পিছনে থাকলে জীবন সহজ হয় সাকিবের। তবে কাল অবশ্য উইকেটের পিছনে মেন্ডিসের ক্যাচ ফেলে কঠিনই করেছেন অধিনায়কের জীবন।
অষ্টম ওভারে আবারও সুযোগ আসে মেন্ডিসকে বিদায় করার, তবে এবার রিভিউ নিতে বড্ড হিসেবি বাংলাদেশ। এবাদতের বাউন্সার কুশলের গ্লাভস ছুঁয়ে গেলেও তা বুঝতে পারেননি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ বছর কিপিং করা মুশফিক। সাকিবকে জানান, কিছু শুনতে পাননি তিনি।
নিয়মিত এমন ভুল করে আর যাই হোক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স সম্ভব নয়। সর্বশেষ বিপিএল ফাইনাল শেষে খালেদ মাহমুদ সুজন বলেছিলেন, ক্রিকেটারদের গেম সেন্সের অভাব রয়েছে। ভুল কিছু বলেননি তিনি। সঙ্গে কতিপয় ক্রিকেটারের নিবেদন নিয়েও আছে প্রশ্ন। সব মিলিয়ে এমন হারের পর আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পক্ষে বাজি ধরার মতো খুব বেশি লোক যে খুঁজে পাওয়া যাবে না তা বলাই বাহুল্য।