রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে টালমাটাল গোটা বিশ্ব। গত ফেব্রুয়ারির শেষে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকটে চরম আকার ধারন করেছে। সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশেও। গ্যাস সংকটে উৎপাদন কমছে শিল্পখাতে। কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদনও। ডলার ও রিজার্ভ সংকটে গ্যাসের আমদানি বন্ধ রয়েছে।
সংকট থেকে উত্তোরণে শুরু থেকেই সরকার নানা বিকল্প উপায় খুঁজছে। এর মধ্যে আশা দেখাচ্ছে নতুন দুটি গ্যাসক্ষেত্র। সম্প্রতি ভোলার শাহবাজপুরের টবগী-১ অনুসন্ধান কূপে বিপুল গ্যাসের সন্ধান মিলছে। এছাড়া সিলেটের বিয়ানীবাজারের পরিত্যক্ত একটি কূপেও গ্যাস পাওয়া কথা জানানো হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। সেখানে প্রথম পরীক্ষণে ১০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস পাওয়া যাবে। কূপগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু হলে সংকট অনেকটা কেটে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সেই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের ১৯ আগস্ট টবগী-১ অনুসন্ধান কূপ খননের কাজ শুরু করে গ্যাজপ্রম। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ৩ হাজার ৫২৪ মিটার গভীরতা পর্যন্ত খনন কাজ সম্পন্ন হয়। এরপর সেখানে সম্ভাব্য মজুত ও উৎপাদনের হার নিরূপণে কারিগরি পরীক্ষা হয়।
৭ নভেম্বর থেকে কূপটি উৎপাদনক্ষম করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছিলেন খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। টবগী-১ থেকে দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস (এমএমসিএফডি) পাওয়ার আশার কথা জানায় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।
ভূতাত্তিক তত্ত্ব অনুযায়ী অনুসন্ধান কূপের গ্যাসের সম্ভাব্য মজুদ প্রায় ২৩৯ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। দৈনিক গড় ২০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস উৎপাদন বিবেচনায় কূপ থেকে ৩০ থেকে ৩১ বছর গ্যাস উৎপাদন করা সম্ভব বলে খনিজসম্পদ বিভাগ থেকে জানানো হয়।
গত ৩ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, ভোলা গ্যাস ফিল্ডের টবগি-১ খনন দারুণভাবে সফল হয়েছে। কূপটি থেকে দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। বাপেক্সের তত্ত্বাবধানে কূপটি খনন করেছে গ্যাজপ্রম। ৩ হাজার ৫১৯ মিটার খনন শেষ হয়েছে। শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রে থেকে টবগী-১ কূপ এলাকাটি আনুমানিক ৩ দশমিক ১৭ কিলোমিটার দূরে। মজুদ বিবেচনায় ৩০-৩১ বছর উত্তোলন করা সম্ভব হবে। প্রতি ইউনিটের মূল্য ১১ টাকা করে ধরলে ৮ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে। তবে এই গ্যাস ব্যবহারের জন্য দুই বছর সময় লাগতে পারে।
একই দিনে প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, আগামী জুন ২০২৩ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে আরও দুটি কূপ ইলিশা-১ ও ভোলা নর্থ-২ খনন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে ৩টি কূপ হতে সর্বমোট দৈনিক ৪৬ থেকে ৫৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হতে পারে। এর জন্য প্রসেস প্ল্যান্ট বসাতে হবে। অন্তত দেড় বছর সময় প্রয়োজন হবে। এখন স্বল্প পরিসরে গ্যাস আনা হবে। পরে স্থায়ীভাবে ভোলা-বরিশাল হয়ে পাইপলাইন করা হবে। আগামী ৩-৪ বছরের মাথায় ৭০০ থেকে ৮০০ মিলিয়ন গ্যাস যোগ করা সম্ভব হবে। তবে চলমান গ্যাস সংকটে শিল্প-কারখানার উৎপাদন ঠিক রাখতে ভোলার কূপ থেকে গ্যাস সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) আকারে আনার পরিকল্পনা গহণ করেছে সরকার। আগামী জানুয়ারি থেকেই সিএনজি করে গ্যাস আনা শুরু হতে পারে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে দৈনিক পাঁচ মিলিয়ন ঘনফুট করে গ্যাস আনা হবে। পরে তা বাড়িয়ে দৈনিক ৫০ মিলিয়ন ঘনফুটে করা হবে।
গত ২৩ অক্টোবর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক সভায় প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের ভোলায় কিছু গ্যাস পাওয়া গেছে। চলমান সংকট মোকাবিলায় সেটা কাজে লাগানোর চিন্তা করছে সরকার। ভোলা থেকে গ্যাস আগামী ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে বার্জের মাধ্যমে ঢাকায় আনতে পারলে ৮০ এমএমসিএফ জাতীয় সঞ্চালন লাইনে যুক্ত হবে।’
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, শিগগির এই কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু হবে। প্রতিদিন এই কূপ থেকে ৭ থেকে ৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ও ১শ ব্যারেল কনডেনসেট সরবরাহ সম্ভব হবে বলে আশাবাদী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠনটি।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. শাহীনুর ইসলাম জানান, বিয়ানীবাজার গ্যাস ফিল্ডের ১ নম্বর কূপটির পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর আগে গত ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২ হতে প্রায় ২ মাস ১ নম্বর কূপে পুনঃ খনন কাজ চালিয়ে ওই কূপের ৩ হাজার ৪৫৪ মিটার গভীর থেকে পরীক্ষা করে গ্যাসের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। পরীক্ষামূলক অবস্থায় ১০ মিলিয়ন গ্যাসপ্রবাহ রয়েছে এবং গ্যাসের চাপ রয়েছে ৩ হাজার ১০০ পিএইচ। ওই কূপটিতে আগামী আরও কিছু পরীক্ষা চলবে। পরীক্ষা শেষে কূপটি থেকে কী পরিমাণ গ্যাস দেওয়া সম্ভব হবে তা নিশ্চিত করা যাবে। ধারনা করা হচ্ছে দৈনিক ৭ থেকে ৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস এবং প্রায় ১০০ ব্যারেল কনডেনসেট সরবরাহ করা যাবে।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) সূত্রে জানা যায়, সিলেট গ্যাস ফিল্ডের অধীন বিয়ানীবাজার গ্যাসক্ষেত্রে দুটি কূপ রয়েছে। ১৯৮১ সালে ওই দুটি গ্যাস কূপের খনন কাজ শুরু হলেও ১ নম্বর কূপ থেকে ১৯৯৯ সালে উৎপাদন শুরু হয়। ২০১৪ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়। ফের ২০১৬ সালের শুরুতে ফের উৎপাদন শুরু হয়ে আবার ওই বছরের শেষদিকে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পর ১ নম্বর কূপে চলতি বছরের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে আবারও গ্যাসের সন্ধানে খননকাজ শুরু করে রাষ্ট্রয়াত্ত গ্যাস উত্তোলন কোম্পানি বাপেক্স। এসজিএফএল’র অধীনে থাকা পরিত্যক্ত গ্যাস কূপগুলোর মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৈলাশটিলা-২, রশীদপুর-২, রশীদপুর-৫ ও হরিপুর-৭ মোট ৪টি কূপ পুনরায় খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আমদানি নির্ভরতার কারণে ব্যয় বৃদ্ধির পাচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত চাপের মুখে পড়েছে। চলমান এ সংকটা থেকে উত্তরেণের উপায় হচ্ছে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ জ্বালানি উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
২০২৩ সালের শেষের দিকে ৪টি কূপের খনন শুরু হবে এবং সেখানেও গ্যাস প্রাপ্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারকে নিজস্ব জ্বালানি উৎপাদনে অনেক আগে থেকেই পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সঠিকভাবে পরামর্শ গ্রহণ করা হলে দেশকে জ্বলানি সংকটে পড়তে হত না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরে সরকারকে বলে আসছি গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়ে। কূপ খননের বিষয়ে। কিন্তু সরকার এটাতে অনীহা দেখিয়েছি। আমাদের দেশে প্রচুর গ্যাস আছে। দেশে তিনটা কূপ খনন করলে একটাতে পাওয়া যায়। কত সম্ভাবনা। আমরা যদি প্রতি বছর একটা করে কূপ খনন করতে পারি তবে আমাদের এই গ্যাস সংকট থাকবে না।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমদানি নির্ভরতার কারণে ব্যয় বৃদ্ধির পাচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত চাপের মুখে পড়েছে। চলমান এ সংকটা থেকে উত্তরেণের উপায় হচ্ছে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অভ্যন্তরীণ জ্বালানি উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে। জ্বালানি খাতে আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এছাড়াও আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকতে হবে।